সৈয়দ জামালুদ্দিন টেরাকোটা মসজিদ, আদি সপ্তগ্রাম

সৈয়দ জামালুদ্দিন টেরাকোটা মসজিদ, আদি সপ্তগ্রাম

বাসুদেবপুর, বাঁশবেড়িয়া, খামারপুরা, দেবানন্দপুর, শিবপুর, কৃষ্ণপুর এবং ত্রিশবিঘা, এই সাতটি গ্রাম নিয়েই সপ্তগ্রাম – পশ্চিমবাংলার প্রাচীন বন্দর। সেই বন্দরের হাতেগোনা কয়েকটি স্থাপত্য ছাড়া আজ আর কিছুই বাকি নেই। তাদের মধ্যে প্রধান, সৈয়দ জামালুদ্দিনের মসজিদ, যা বাংলার টেরাকোটার অর্থাৎ পোড়ামাটির স্থাপত্যের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু সৈয়দ জামালুদ্দিনের মসজিদের কথা লিখতে গেলে, আগে লিখতে হয় সপ্তগ্রামের কথা।

ইতিহাসবিদ নীহার রঞ্জন রায় হিন্দু পুরাণে সরস্বতী নদীর কথা বলেন। তাঁর মতে এই নদীই ছিল আজকের গঙ্গার আদি গতিপথ, এবং তার তীরেই সপ্তগ্রাম। সরস্বতী নদী আজ খালে পরিবর্তিত হয়ে কোনোমতে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। সাতটি গ্রামের মধ্যে ত্রিশবিঘা গ্রামকে আজ আমরা জানি “আদি সপ্তগ্রাম” নামে, এবং সেই নামেই স্থানীয় রেল স্টেশন। সপ্তগ্রাম বন্দরের বিকাশ শুরু ১২৯৮ সাল থেকে যখন এই এলাকা যুদ্ধ করে দখল করেন জাফর খাঁ গাজি। দিল্লির বাদশা, মোহম্মদ বিন তুঘলক সপ্তগ্রামে তৈরি করিয়েছিলেন টাঁকশাল, যেখান থেকে রুপোর মুদ্রা তৈরি শুরু হয় ১৩২৮ সালে। আশ্চর্যের বিশয় এই, যে ভারতে তখন রুপোর খুব বড় কোনো খনি ছিল না। দেশের মুদ্রা তৈরির জন্যে ব্যবহৃত সোনা এবং রুপো আসতো বাইরে থেকে। এর থেকে আন্দাজ করাই যায় যে সপ্তগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালোই হত, যার ফলে যথেষ্ট সোনা এবং রুপো এখানে আসতো।

উত্তর-পুর্ব দিক থেকে

উত্তর-পুর্ব দিক থেকে

১৪৯৪ সালে তাঁর রচিত কাব্যে, বিপ্রদাস পিপিলাই সপ্তগ্রামের এবং তার সমৃদ্ধির উল্লেখ করেন। কিন্তু ওই অঞ্চলেই পাওয়া ১৫০৫ সালের একটি প্রস্তরফলকের লিপি থেকে আমরা জানতে পারি যে সে বছর বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্‌ সপ্তগ্রাম থেকে ত্রিবেণীর দিকে একটি সেতু তৈরির কাজ শুরু করান। এর থেকে ইতিহাসবিদ অনিরুদ্ধ রায় আন্দাজ করছেন যে হয়তো সেই সময় থেকেই নদীর গতিপথ পালটাতে শুরু করে। তার ১৬ বছর পরে বাংলায় আসেন পর্তুগিজ অ্যান্টোনিও ডি ব্রিটো, এবং সপ্তগ্রাম থেকে রাজধানী গৌড়ে যাওয়া অনেক বেশি সহজ হওয়া সত্ত্বেও, তিনি জাহাজ নিয়ে যান চট্টগ্রামে। সপ্তগ্রামে শেষ বড় জাহাজের উল্লেখ আমরা পাই ১৫৬০ নাগাদ, সিজার ফ্রেদেরিচির লেখায়। সম্রাট আকবরের বাংলা দখল করার পর, ১৫৭৯ সালে যখন পর্তুগিজ ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছ থেকে নতুন বন্দর এবং উপনিবেশ তৈরি করার অনুমতি নেন, তা তৈরি হয় হুগলীতে। এর থেকেই স্পষ্ট যে ষোড়শ শতকের শেষের দিকেই বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সপ্তগ্রামের গুরুত্ব অনেক কমে গিয়েছিল।

অদ্ভুত ভাবে, ভারতে ইসলাম ধর্মের সঙ্গে বাণিজ্যের একটি যোগসূত্র রয়েছে। এদেশে ইসলাম প্রথম আসে আরব ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। কাজেই, সপ্তগ্রাম যদি একটি বড় বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে যে ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ এবং ইসলাম ধর্ম প্রচারকরা থাকবেন, তাতে আশ্চর্যের কিছুই নেই। তাঁদেরই একজন সৈয়দ জামালুদ্দিন, কিন্তু তাঁর কথায় আসার আগে, তাঁর মসজিদের একটু বর্ণনা দিই। পাথরের অভাবে বাংলায় মন্দির এবং মসজিদ নির্মাণে পোড়ামাটির ব্যবহার অনেক বছর ধরেই চলে আসছে। মন্দিরে পৌরাণিক দৃশ্য, সেকালের সামাজিক দৃশ্য অথবা দেব-দেবীর প্রতিকৃতি আমরা দেখতে পাই। কিন্তু ইসলাম ধর্মে তা সম্ভব নয়, কারণ মানুষের প্রতিকৃতি তৈরি করা নিষিদ্ধ এবং আল্লাহ নিরাকার। মসজিদের অলংকরণে তাই আমরা দেখতে পাই হয় ফুল-পাতার কারুকাজ, নাহলে জ্যামিতিক নকশা। এর সঙ্গে, বাংলায় মসজিদ নির্মাণের এক বিশেষ শৈলী গড়ে ওঠে, যার বর্ননা দিয়েছেন রিচার্ড ইটন তাঁর বই The Rise of Islam and the Bengal Frontier-এ। মোগল মসজিদের তিনটি অথবা পাঁচটি উল্টোনো পেঁয়াজের মত দেখতে গম্বুজের জায়গায় এখানে আমরা দেখি একাধিক ছোট ছোট গো্লাকার গম্বুজ। মসজিদ আকারে চৌকো, এবং তার সামনে খোলা চাতাল নেই। বাংলায় যা বৃষ্টি হয়, খোলা চাতালে নামাজ পড়া বছরে অন্তত তিন মাস এক প্রকার অসম্ভব।

পশ্চিমের দেওয়াল এবং পাথরের থাম

পশ্চিমের দেওয়াল এবং পাথরের থাম

সৈয়দ জামালুদ্দিনের মসজিদ আকারে আয়তক্ষেত্রাকার, লম্বায় ১৪ মিটার, এবং চওড়ায় ৯ মিটার। পুবদিকের দেওয়ালে রয়েছে তিনটি দরজা, যার মধ্যে দিয়ে দেখা যায় পশ্চিমের দেওয়ালের টেরাকোটা অলংকরণ সমৃদ্ধ তিনটি মেহেরাব, যা নামাজিকে মক্কার দিকনির্দেশ করে। মসজিদের ছাদ বহুকাল আগেই ধসে গেছে, এবং গম্বুজের কোনো অবশেষ এখন আর চোখে পড়ে না। চারটি কোণে চারটি মিনার এককালে ছিল। কিন্তু এখন শুধুমাত্র উত্তর পশ্চিম কোণের মিনারটি দেখা যায়। যদিও এই মিনারের ওপরে উঠে আজান দেওয়া সম্ভব নয়। এগুলো শুধুমাত্র সৌন্দর্যায়নের কারণেই রয়েছে। মসজিদের উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে আরও দু’টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। প্রার্থনাকক্ষের ভেতরে দু’টি পাথরের থামের অবশেষ দেখা যায়। এমন আরও ভাঙা পাথরের থামের টুকরো মসজিদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এমন থাম ত্রিবেণীর জাফর খাঁ গাজির মসজিদের ভেতরেও দেখা যায়। মসজিদের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের কাছে একটি উঁচু বেদির ওপরে রয়েছে তিনটি কবর। দু’দিকের দু’টি কবর পুরুষের, এবং মাঝখানেরটি মহিলার। এটা সহজেই বোঝা যায় কবরের ওপরে পাথর থেকে। পুরুষের কবরের ওপর একটি তিনকোনা পাথর বসানো থাকে, যাকে বলে ‘কালাম’, কিন্তু মহিলাদের কবরের ওপর শুধুমাত্র সমান একটি পাথরের ফলক দেওয়া থাকে যাকে বলে ‘তক্তি’।

১৮৭০ সালে গবেষক হায়েনরিখ ব্লকম্যান সপ্তগ্রামে আসেন এবং এশিয়াটিক সোসাইটির জন্যে মসজিদের পুবদিকের দেওয়ালের প্রস্তরলিপির তর্জমা করেন। এই প্রস্তরলিপি থেকে আমরা জানতে পারি যে এই মসজিদটি তৈরি হয়েছিল সুলতান আবুল মুজাফ্ফর নসরত শাহ-এর সময়ে। তৈরি করিয়েছিলেন সৈয়দ জামালুদ্দিন হোসেন, যার বাবার নাম সৈয়দ ফখরুদ্দিন, যিনি এসেছিলেন আমুল বলে একটি জায়গা থেকে। মসজিদ তৈরির সময় মুসলমান মতে, রমজান ৯৩৬ হিজরি, অর্থাৎ ১৫২৯ সালের মে মাস। এই লিপিটি একটি কালো ব্যাসল্ট ফলকের ওপরে লেখা। কবর তিনটির কাছে এমন আরও লিপি রয়েছে, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি এই এলাকার ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়া অন্য কিছু মসজিদ থেকে। সব কটিই আরবি ভাষায়, তুঘ্রা হরফে লেখা। তিনটি কবরের মধ্যে দু’টি জামালুদ্দিনের মা এবং বাবার কবর বলেই সবার ধারণা। তৃতীয়টি হয় তাঁদের ‘খোজা’ অর্থাৎ গুরুর, অথবা তাঁদের পরিচারকের।

সৈয়দ ফখুরুদ্দিন এবং তাঁর পরিবারের কবর

সৈয়দ ফখুরুদ্দিন এবং তাঁর পরিবারের কবর

ব্লকম্যানের মতে, লিপিতে যে আমুল জায়গাটির উল্লেখ রয়েছে, তা ইরানের আমোল, কিন্তু অন্য অনেকের মত যে এটা আসলে তুর্কিস্তানের শহর তুর্কমেনাবাদ, যার প্রাচীন নাম আমুল। যেহেতু তুর্কমেনাবাদ একসময়ের ‘সিল্ক রুটে’-এর ওপরে পড়ত, এমন হতেই পারে যে ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই এক সময়ে ফখরুদ্দিন এদেশে এসেছিলেন। হোসেন শাহী আমলের স্থাপত্যশৈলীর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন সৈয়দ জামালুদ্দিনের মসজিদ এবং সপ্তগ্রামের ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলির মধ্যে একমাত্র এটিই অপেক্ষাকৃতভাবে অপরিবর্তিত রয়েছে।

মিয়াঁ হিলাল মসজিদ, মুর্শিদাবাদ

মিয়াঁ হিলাল মসজিদ, মুর্শিদাবাদ