খেরুর টেরাকোটা মসজিদ

খেরুর টেরাকোটা মসজিদ

আমাদের বাংলায় সব কিছুই একটু অন্যরকম, আর সবার থেকে একটু আলাদা। ধর্মের ক্ষেত্রেও আমরা ব্যেতিক্রমি। ঠিক যেমন বাঙালি হিন্দু ধর্ম উত্তর ভারতের অন্য রাজ্যের থেকে আলাদা, তেমনই আমাদের রাজ্যে ইসলাম ধর্ম এবং মসজিদ তৈরির শৈলীও পৃথক।

বাংলায় মুসলমান শাসন তুর্কি আক্রমণকারী বখতিয়ার খিলজির সঙ্গে শুরু হলেও, বাংলায় ইসলাম এসেছে তার আগেই। লক্ষন সেনকে বখতিয়ার যুদ্ধে হারানর অনেক আগেই, দিল্লির সুলতান সামসুদ্দিন ইলতুতমিসের শাসনকালে পান্ডুয়ায় এসে ঘাঁটি গেড়ে বসেন শেখ জালালুদ্দিন তাব্রিজি। লক্ষন সেন তাঁকে ইসলাম ধর্মপ্রচার করার অনুমতি দেন। শোনা যায় শেখ জালালুদ্দিন নাকি বখতিয়ারের হামলার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণীও করেছিলেন, কিন্তু সে কথায় আমল দেননি লক্ষন সেন।

খেরুর মসজিদ - পূবদিকের বারান্দা

খেরুর মসজিদ - পূবদিকের বারান্দা

এখন মসজিদ বললেই আমাদের চোখের সামনে যে ছবিটি ফুটে ওঠে – তিন অথবা পাঁচ গম্বুজ, উঁচু উঁচু মিনার, সামনে একটি বড় খোলা চাতাল, এটা কিন্তু আদপে মোগল মসজিদের রুপ। কিন্তু আমাদের রাজ্যের প্রাচীন মসজিদ তৈরি হয় দেশে মোগল শাসন শুরু হওয়ার ঢের আগে। কেমন ছিল সেই সময়কার বাংলার প্রাচীন মসজিদ? রিচার্ড ইটন তাঁর বই The Rise of Islam and the Bengal Frontier-এ এই মসজিদের স্থাপত্যের বিশেষত্বগুলো তুলে ধরেন। মোগল মসজিদের তিনটি অথবা পাঁচটি উল্টোনো পেঁয়াজের মত দেখতে গম্বুজের যায়গায় এখানে আমরা দেখি একাধিক ছোট ছোট গো্লাকার গম্বুজ। মসজিদ আকারে চৌকো, এবং তার সামনে খোলা চাতাল নেই। বাংলায় যা বৃষ্টি হয়, খোলা চাতালে নামাজ পড়া বছরে অন্তত তিন মাস এক প্রকার অসম্ভব। বাংলায় যেহেতু পাথর পাওয়া প্রায় যায়না বললেই চলে, অধিকাংশ মসজিদই ইটের তৈরি। তার সঙ্গে আর একটি বিশেষত্ব হল এই মসজিদগুলতে টেরাকোটা অর্থাৎ পোড়ামাটির অলঙ্করণ।

পাথরের অভাবে বাংলায় পোড়ামাটির মন্দির এবং মন্দির অলঙ্করণ অনেক বছর ধরেই চলে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমান শাসকরা এই প্রথাকে মসজিদে কাজে লাগান। বাংলার সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলার টেরাকোটা শিল্পের বিকাশ ঘটে। মন্দিরে পৌরাণিক দৃশ্য, সেকালের সামাজিক দৃশ্য অথবা দেব-দেবীর প্রতিকৃতি আমরা দেখতে পাই। কিন্তু ইসলাম ধর্মে তা সম্ভব নয়, কারণ মানুষের প্রতিকৃতি তৈরি করা নিষিদ্ধ এবং আল্লাহ নিরাকার। মসজিদের অলঙ্করণে তাই আমরা দেখতে পাই হয় ফুল-পাতার কারুকাজ, নাহলে জ্যামিতিক নকশা।

খেরুর মসজিদের পশ্চিমদিকের দেওয়াল, মেহেরাব, এবং টেরাকোটা অলঙ্করন

খেরুর মসজিদের পশ্চিমদিকের দেওয়াল, মেহেরাব, এবং টেরাকোটা অলঙ্করন

মুর্শিদাবাদ শহর থেকে আন্দাজ ৪৩ কিলোমিটার উত্তরে ছোট্ট গ্রাম খেরুর। বাংলার আর পাঁচটা গ্রামের থেকে তেমন আলাদা কিছু নয়। ক্ষেত, চাষ, মাটির বাড়ি, ছবির মত সুন্দর। কিন্তু খেরুরকে আর পাঁচটা গ্রামের থেকে আলাদা করে দেয় খেরুরের মসজিদ। গুগলে সার্চ করলেই খুঁজে পাবেন “খেরুর হেরিটেজ মস্ক”, অথবা ব্যাবহার করতে পারেন এই ল্যাটিচিউড এবং লঙ্গিচিউড - 24°20'57.8"N 88°04'23.4"E। গ্রামের এক প্রান্তে, একটি ছোট ঢিপির ওপর রয়েছে খেরুর মসজিদ।

আকার আয়তনের দিকে দিয়ে খেরুর মসজিদ ইটনের বিবরণের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। চৌকো মসজিদ, পূবদিকে তিনটি খিলান দেওয়া দরজা। পূবদিকের তিনটি ছোট গম্বুজ এখনো রয়েছে। কিন্তু প্রার্থনা কক্ষের ওপরের একটি বড় গম্বুজ বহুকাল আগেই ধ্বসে গেছে। পূবদিকের দেওয়ালের কিছু ইট খসে গিয়ে থাকলেও, অপূর্ব সুন্দর টেরাকোটার কাজ এখনো বিদ্যমান। কিন্তু সব থেকে সুন্দর টেরাকোটার কারুকাজ রয়েছে প্রার্থনা কক্ষের ভিতরে, পশ্চিমদিকের দেওয়ালে।

প্রার্থনা কক্ষের ধ্বসে যাওয়া ছাদ

প্রার্থনা কক্ষের ধ্বসে যাওয়া ছাদ

ভারতের মসজিদের প্রবেশপথ সাধারণত পূবদিকেই থাকে। ঢুকেই সামনে পড়ে পশ্চিমদিকের দেওয়াল। এই দেওয়ালকে বলা হয় কিব্লা ওয়াল। নামাজ পড়ার সময় নামাজীর মুখ থাকা উচিৎ মক্কার দিকে। এই কিব্লা ওয়াল সেই মক্কার দিক নির্দেশেরই কাজ করে। কিব্লা ওয়ালে সাধারণত এক বা একাধিক কুলুঙ্গির ব্যাবস্থা করা থাকে, যার নাম মেহেরাব। বাংলার পোড়ামাটির মসজিদে এই মেহেরাবের ওপরেও দেখা যায় টেরাকোটার কাজ, এবং খেরুর মসজিদ সেদিক দিয়ে ব্যাতিক্রমি নয়। মসজিদের ভেতরে দেখা যায় ইটের দেওয়ালে কিছু পাথরের থামের ব্যাবহারও করা হয়েছে।

খেরুর মসজিদের পূবদিকের দেওয়ালের মাঝখানের খিলানের ওপরে রয়েছে দুটি পাথরের ফলক। এই দুটি কালো পাথরের ফলকে সম্ভবত আরবি ভাষায়, তুঘ্রা হরফে লেখা রয়েছে মসজিদের স্থাপনের কথা। জর্জ মিচেল সম্পাদিত “The Islamic heritage of Bengal” বই থেকে আমরা জানতে পারি যে পাথরের লিপির তর্জমা করলে জানা যায় যে ১৪৯৫ ক্রিস্টাব্দে খেরুর মসজিদ তৈরি করিয়েছিলেন রাফাত খাঁ বলে এক উমরা, যিনি ছিলেন বাংলার সুলতান হোসেন শাহের সভাসদ। দুর্ভাগ্যবশত, দুটি লিপির সম্পূর্ণ তর্জমা আমি কোথাও খুঁজে পাইনি। কিন্তু হোসেন শাহী শাসনকালের মসজিদের শৈলী, যাকে বলে এক্কেবারে মার্কামারা – দেখলেই চেনা যায়, এবং এই সময়কার আরও অনেক মসজিদ আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পশ্চিমবাংলার এবং বাংলাদেশের নানান গ্রামে।

খেরুর মসজিদের প্রতিষ্ঠালিপি

খেরুর মসজিদের প্রতিষ্ঠালিপি

নির্মাণের ৫০০ বছর পরেও, খেরুরের মসজিদে আজও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়। মুর্শিদাবাদ জেলার সম্ভবত ৭৩% শতাংশ মানুষ মুসলমান। খেরুরের গ্রামবাসী আজও তাঁদের এই প্রাচীন মসজিদেই নামাজ পড়েন প্রত্যহ।  

সংরক্ষণ বিভ্রাটঃ নুতনহাট টেরাকোটা মসজিদ

সংরক্ষণ বিভ্রাটঃ নুতনহাট টেরাকোটা মসজিদ

কলকাতার ক্ষুদ্রতম মসজিদ

কলকাতার ক্ষুদ্রতম মসজিদ