মিয়াঁ হিলাল মসজিদ, মুর্শিদাবাদ

মিয়াঁ হিলাল মসজিদ, মুর্শিদাবাদ

ট্রেন মিস করে, গাড়ি করে কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যেতে গিয়ে প্রথম খেয়াল করি ব্যাপারটা। মুর্শিদাবাদ শহরের যত কাছে আসছি, তত মসজিদের সংখ্যা বাড়ছে। লালবাগে ঢুকলে মনে হয় যেন চার পা অন্তর একটা করে মসজিদ। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, মুর্শিদাবাদ টাউনের জনসংখ্যা মাত্র ৪৪,০১৯। যে শহরে মানুষের সংখ্যা এত কম, সেখানে মসজিদ এত বেশি কেন?

আরও অদ্ভুত ব্যাপার, বেশিরভাগ মসজিদের স্থাপত্যশৈলী এক ধরণের। একটি মাঝারি মাপের, উঁচু, পাঁচিলে ঘেরা চাতাল, পুবদিকে, পাঁচিলের মধ্যেই বসানো প্রবেশপথ, ৭-৮ ধাপ সিঁড়ি, এবং চাতালের পশ্চিম দিকে তিন গম্বুজের মসজিদ। তিনটি গম্বুজের নিচে স্বাভবিক ভাবেই তিনটি খিলান দেওয়া দরজা। মিল এখানেই শেষ নয়। এই ছোট ছোট মসজিদগুলির সিংহভাগের ভেতরটাও একই ধরণের দেখতে, এবং খোঁজ নিলে দেখা যাবে, বেশিরভাগ মসজিদ তৈরি হয়েছে একই সময়ে – ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের আসে পাশে। হঠাৎ করে এই সময়ে শহর জুড়ে এতগুলো মসজিদ তৈরি হলো কেন? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে নেই।

একটা ব্যাপার অবশ্য খেয়াল রাখতে হবে। মুর্শিদাবাদে প্রধানত শিয়া মুসলমান সম্প্রদায়ের বাস। মুর্শিদাবাদের নবাবরাও শিয়া মুসলমান ছিলেন। আমার বন্ধু ইতিহাসবিদ পুষ্কর সোহোনি আমায় বলেছিলেন যে শিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ অনেক সময়েই একটি বড় মসজিদ তৈরি না করিয়ে, অনেকগুলো ছোট ছোট মসজিদ তৈরি করান। এটা একটা সম্ভাব্য কারণ হতেও পারে।

মিয়াঁ হিলাল মসজিদের গম্বুজ

মিয়াঁ হিলাল মসজিদের গম্বুজ

২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে আমি মুর্শিদাবাদ যাই। ভাদুরিয়া পাড়ায় একটি নির্মিয়মান হোটেলের ছাদ থেকে দেখতে পাই এমনই একটি ছোট মসজিদ (জি পি এস - 24°10'51.1"N 88°16'15.5"E), এবং ঠিক করি ভেতরে ঢুকে ছবি তুলবো। মসজিদের সামনে পৌঁছে দেখি পুর্বোক্ত বিবরণের সঙ্গে এই মসজিদ মিলে যাচ্ছে প্রায় হুবহু। তফাত শুধু একটাই – ঢোকার সিঁড়ির ডানদিকে একটি কুয়ো। নামাজ পড়ার আগে একটি বিশেষ কায়দায় হাত, পা এবং মুখ ধুতে হয়, যাকে বলা হয় ওজু। এই ওজু করার জন্যে অনেক মসজিদে একটি আলাদা জায়গা থাকে, যাকে বলা হয় ওজুখানা। কুয়ো যদিও এখন শুকনো এবং জঞ্জালে ভর্তি, বুঝলাম এক সময়ে ওজু করার জল ওই কুয়ো থেকেই আসতো।

মসজিদের প্রবেশপথ এবং কুয়ো

মসজিদের প্রবেশপথ এবং কুয়ো

সিঁড়ি দিয়ে উঠে ভেতরে ঢুকে দেখি মসজিদের অবস্থা খুব যে ভালো তা নয়। মেরামতের কাজ বহুদিন হয়নি। মসজিদের এবং মসজিদের দেওয়ালের অনেক জায়গা থেকে চুন উঠে গিয়ে ভিতরের ইট বেরিয়ে পড়েছে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে যে মসজিদের গায়ে এক সময়ে খুব সুন্দর চুন-সুরকির কাজ করা ছিল। এই ধরণের মসজিদের মিনার খুব উঁচু হয়না। এখানেও তাই। চার কোণে চারটি মিনার, এবং মাঝখানে গম্বুজের পেছনে আরও দু’টি ছোট মিনার। মসজিদের মিনারের ওপর থেকেই আজান দেওয়ার কথা, কিন্তু এই ধরণের মসজিদের মিনার শুধুই সৌন্দর্যায়নের কারণে ব্যবহার করা হয়।

ইটের চাতাল পেরিয়ে মসজিদে ঢুকি। মসজিদের দরজা এক সময়ে নিশ্চয়ই কাঠের ছিল। এখন তার জায়গায় রয়েছে পাতলা টিনের দরজা। মসজিদের ভেতরে দেওয়ালে সর্বত্র সূক্ষ্ম চুন-সুরকির কারুকাজ। ভেতরে যে ধরণের পল-কাটা খিলান রয়েছে, তাকে ইংরেজিতে বলা হয় scalloped arch। পশ্চিমের দেওয়ালে তিনটি কুলুঙ্গি, যাকে বলা হয় মেহেরাব, যা নামাজিদের মক্কার এবং কাবার দিকনির্দেশ করে। মেহেরাবের ভেতরেও রয়েছে চুন-সুরকির কারুকাজ। মসজিদের অবস্থা খুব ভালো না হলেও, এখানে এখনো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয়।

মসজিদের মেহেরাব (ডানদিকে) এবং scalloped arch

মসজিদের মেহেরাব (ডানদিকে) এবং scalloped arch

মসজিদের ইমামের সঙ্গে কথা বলে জানা গেলো যে মসজিদের নাম মিয়াঁ হিলাল মসজিদ। কিন্তু মসজিদের মাঝের দরজার ওপরে যে পাথরের ফলক রয়েছে, তা বলছে অন্য কথা। গবেষক আবুল বর্কত জিলানী লেখার তর্জমা করেছেন –

میان ھلال کہ بدرسپھرو  وفاست        ستارہ  وارد  ز بی  سیار   حشر  بدا

چوساخت مسجد ی بھر نماز خلقِ خدا      نوشت منشی  اعجاز  سال  ذات عماد

তাঁর মতে এর অর্থ “এক ধর্মপ্রাণ মানুষের উচিত সর্বদা আল্লাহ্‌র কথা স্মরণ করা। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত, তাঁর প্রার্থনাই তাঁকে রক্ষা করবে। যখন মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য এই মসজিদ তৈরি হয়, তখন মুনশি আজিজ মসজিদের নির্মানের তারিখ লিখে রাখেন”। পাথরের বাঁদিকের নিচের কোণে, ছোট ছোট হরফে লেখা রয়েছে একটি সাল – ১২১৬। এটি মুসলমান হিজরি তারিখ। হিসেব করলে দেখা যাবে যে ১২১৬ হিজরি মানে ১৮০১-১৮০২ খ্রিস্টাব্দ।

মসজিদের প্রতিষ্ঠাফলক

মসজিদের প্রতিষ্ঠাফলক

কিন্তু মুনশি আজিজের তৈরি মসজিদের নাম আজ মিয়াঁ হিলাল মসজিদ কেন, এ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি পাইনি। মুর্শিদাবাদের এই ধরণের ছোট মসজিদ যত আছে, সবকটার ফলকের তর্জমা করতে পারলে, হয়তো শহরের ইতিহাসের ব্যাপারে আরও জানা যাবে।

সৈয়দ জামালুদ্দিন টেরাকোটা মসজিদ, আদি সপ্তগ্রাম

সৈয়দ জামালুদ্দিন টেরাকোটা মসজিদ, আদি সপ্তগ্রাম

মুর্শিদাবাদের গৌরব - কাটরা মসজিদ

মুর্শিদাবাদের গৌরব - কাটরা মসজিদ