সংরক্ষণ বিভ্রাটঃ নুতনহাট টেরাকোটা মসজিদ
একটি স্থাপত্য, যেটা বেশ কিছুটা ধ্বংস অথবা নষ্ট হয়েই গেছে, তার সংরক্ষণ কিভাবে করা উচিৎ? আমরা কি তাকে সারিয়ে, এক্কেবারে ঝাঁচকচকে নতুনের মত দেখতে করে দেবো? নাকি আমরা কাঁধ ঝাঁকিয়ে, “ওর আর কিছু করা যাবেনা” বলে হাল ছেড়ে দেবো? নাকি আমরা চেষ্টা করব যে স্থাপত্য যা নষ্ট হয়ে গেছে এর মধ্যেই, তার থেকে আর বেশি যেন না হয়? নুতনহাটের হোসেন শাহী আমলের মসজিদের ক্ষেত্রে, তিনটের কোনটাই হয়নি।
বর্ধমান রেল স্টেশান থেকে ৪০ কিলোমিটার উত্তরে, নুতনহাটের হোসেন শাহী আমলের মসজিদ। ল্যাটিচিউড এবং লঙ্গিচিউড 23 32.2736N 87 54.2724E, অথবা গুগল ম্যাপে Natunhat Bhanga Masjid লিখে সার্চ করলেই খুঁজে পাওয়া যাবে। মসজিদ এক সময়ে সত্যি ভাঙ্গা ছিল, কিন্তু এখন তার যা অবস্থা, তাকে গলা মসজিদ বললে আরও যথাযথ হবে।
নুতনহাটের মসজিদের কোনো প্রতিষ্ঠালিপি বা ফলক আমরা এখন দেখতে পাইনা, কিন্তু ফলক এক সময় নিশ্চয়ই ছিল, নাহলে তারাপদ সাঁতরা তাঁর বই ‘পশ্চিমবাংলার ধর্মীয় স্থাপত্য’-তে (১৯৯৮) মসজিদের নির্মাণকাল ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দ লিখতে পারতেন না। মসজিদের অথবা কবরের পাথর পানওয়ালাদের মধ্যে বিশেষভাবে জনপ্রিয়, বলছেন হেরিটেজ ওয়াক ক্যালক্যাটার কর্নধার, তথাগত নিয়োগী। এই ধরণের পাথরের ওপরে রাখলে নাকি পান পাতা ভালো থাকে। সে কারণেই, পান বিক্রেতারা অনেক সময় ঘুষ দিয়ে বা অন্য উপায়ে এই পাথর জোগাড় করেন।
বাংলার সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ্-এর শাসনকাল ১৪৯৪ থেকে ১৫১৯। এই সময়ে তৈরি মসজিদের একটি নিজস্ব শৈলী ছিল, যার কথা আমি আগেই লিখেছি। রিচার্ড ইটন তাঁর বই The Rise of Islam and the Bengal Frontier-এ এই মসজিদের স্থাপত্যের বিশেষত্বগুলো তুলে ধরেন। মোগল মসজিদের তিনটি অথবা পাঁচটি উল্টোনো পেঁয়াজের মত দেখতে গম্বুজের যায়গায় এখানে আমরা দেখি একাধিক ছোট ছোট গো্লাকার গম্বুজ। মসজিদ আকারে চৌকো, এবং তার সামনে খোলা চাতাল নেই। বাংলায় যা বৃষ্টি হয়, খোলা চাতালে নামাজ পড়া বছরে অন্তত তিন মাস এক প্রকার অসম্ভব। বাংলায় যেহেতু পাথর পাওয়া প্রায় যায়না বললেই চলে, অধিকাংশ মসজিদই ইটের তৈরি। তার সঙ্গে আর একটি বিশেষত্ব হল এই মসজিদগুলতে টেরাকোটা অর্থাৎ পোড়ামাটির অলঙ্করণ। এতটাই স্বতন্ত্র এই মসজিদ নির্মাণ শৈলী, যে হোসেন শাহী আমলের মসজিদ দেখলেই চেনা যায়। এই মসজিদ চৌকো নয়, বরং আয়তক্ষেত্রাকার।
বর্তমানে মসজিদের পুব এবং পশ্চিমদিকের দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই। কিন্তু তারাপদ সাঁতরা লিখছেন যে মসজিদের এক সময় চারটি গম্বুজ ছিল। এটাই বা উনি জানছেন কি করে? এই আন্দাজ উনি সম্ভবত করেছেন মসজিদের খিলানের সংখ্যা থেকে। পুবদিকের দেওয়ালে রয়েছে চারটি খিলানযুক্ত প্রবেশদ্বার। পশ্চিমদিকের দেওয়াল, অর্থাৎ কিব্লা ওয়াল, যা নামাজীকে মক্কার দিকনির্দেশ করে, সেই দেওয়ালে এই চারটি খিলানের নিচে রয়েছে চারটি কুলুঙ্গি, যাকে বলা হয় মেহেরাব। পুবদিকের দেওয়ালে কম, এবং পশ্চিমদিকের দেওয়ালে এবং মেহেরাবে অনেক বেশি যেটা দেখা যায়, সেটা হল টেরাকোটা বা পোড়ামাটির নকাশি ফলক। দুদিকের দেওয়ালেই ইটের সঙ্গে কিছু পাথরের ব্যাবহার আছে। পাথরের থামের টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গোটা চত্তরেই। মসজিদটি তৈরি একটি সামান্য উঁচু ঢিপির ওপর, যার থেকে আন্দাজ করা যায় যে হয়ত এখানে এক সময় অন্য স্থাপত্য ছিল। খুব সাবধানে খুঁড়লে হয়ত সেই স্থাপত্যের কিছু ধ্বংসাবশেষ এখনো পাওয়া যেতে পারে। মসজিদের পশ্চিমদিকের জমি এখনো স্থানীয় মুসলমান গোরস্থান হিসেবে ব্যাবহার করা হয়।
মসজিদের পশ্চিমের দেওয়ালের একটি থামের ওপর খোদাই করা লিপি খুঁজে পাই। দেখে যা মনে হয়, এ লিপি সম্ভবত পাল আমলের, এবং অক্ষরগুলি দেখতে দেবনাগরীর মত হলেও, এ ভাষা বাংলা, হিন্দি বা সংস্কৃত নয়। বরং একে প্রাক-বাংলা বলা চলে। আশঙ্কা হচ্ছে এই ধরণের লিপির ছবি দিলেই, কিছু মানুষ লাফিয়ে উঠে বলবেন যে এই হচ্ছে প্রমান যে মসজিদ মন্দির ধ্বংস করে তৈরি করা। আমার এখানে দুটি বক্তব্য। প্রথম, মন্দিরের পাথর ব্যাবহার করা মানেই মন্দির ধ্বংস করা নয় – মন্দির পরিত্যক্ত অথবা স্বাভাবিক কারণে ধংসপ্রাপ্তও হতে পারে। দ্বিতীয়, মন্দিরের পাথর হলে, তাতে এমন কাঁচা হাতের কাজ থাকতো না। লিপি আরও অনেক সুন্দর হত, যেমন আমরা দেখি ত্রিবেণীর জাফর খাঁ গাজির দরগায়। এই লিপি কারুর বাড়ি বা কোনো দুর্গের হতে পারে, অথবা পাথর যিনি কেটেছেন, তাঁর স্বাক্ষরও হতে পারে।
কিন্তু নুতনহাটের হোসেন শাহী মসজিদ অনেকটা ধ্বংস হয়ে গিয়ে থাকলেও, তার একেবারে পিন্ডি চটকে দিয়েছে আমাদের রাজ্য সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ। সম্ভবত ২০১৮ নাগাদ, স্থানীয় মানুষের দাবিতে, মসজিদটি সংরক্ষনের কাজ শুরু করা হয়। কাজের দায়িত্ব পায় পাব্লিক ওয়ার্ক্স ডিপার্টমেন্ট, অর্থাৎ পি ডাব্লিউ ডি। তারা যে ঠিক কি করেছে মসজিদে, তা বলা শক্ত, তবে এই মুহুর্তে মসজিদের চেহারা খানিক ভয়ানক, খানিক হাস্যকর। দেখলে মনে হয় যেন মসজিদের দেওয়ালের ওপরে কেউ সস্তার আইস ক্রিম ঢেলে দিয়েছে, যা ধীর ধীর গলে যাচ্ছে। মসজিদের মেঝে একসময় কেমন ছিল, তা আর বোঝার কোনো উপায় নেই, কারণ মেঝে হালফ্যাশানের টাইল দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে, সংরক্ষণের আগে, মসজিদের একটি ছবি তুলেছিলেন বন্ধু অমিতাভ গুপ্ত। তার সঙ্গে মসজিদের আজকের চেহারা তুলনা করলে, মনে হয় এই মসজিদ অসংরক্ষিতই ভালো ছিল।
আমাদের ভাগ্য ভালো যে নুতনহাটের গলা মসজিদ…থুড়ি…ভাঙ্গা মসজিদে আরও সংরক্ষণের কাজ করা হয়নি। পোড়ামাটির কাজ যা ছিল, তা ইতিমধ্যেই অর্ধেক ঢাকা পড়ে গেছে, অথবা নষ্ট হয়ে গেছে। রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগের কাছে আমার একটাই অনুরোধ – যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, এখানে অন্তত আর কিছু করবেন না।