কলকাতার ক্ষুদ্রতম মসজিদ
সবথেকে বড়, সবথেকে পুরোনো, সবথেকে সুন্দর, এরকম মসজিদ নিয়ে তো অনেক লেখাই পাওয়া যায়। কিন্তু সবথেকে ছোট মসজিদ নিয়ে খুব বেশি লেখা বোধহয় নেই। অবশ্য এই বিশেষ মসজিদটিই যে কলকাতার ক্ষুদ্রতম, নিশ্চিত ভাবে তা আমি বলতে পারব না। ফিতে হাতে কলকাতার মসজিদে মসজিদে আমি মাপজোখ করে বেড়াইনি। কিন্তু যে মসজিদের ভেতরে ছ’জনের বেশি একসঙ্গে নামাজ পড়তে গেলে হাঁটুতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগে যেতে পারে, সেই মসজিদ ক্ষুদ্রতম না হলেও, ক্ষুদ্র তো বটেই।
কথা হচ্ছে গড়চা মসজিদের। দক্ষিণ কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকার গড়চা রোডে অবস্থিত মসজিদটির ব্যাপারে প্রায় কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। ঠিক কবে যে মসজিদটি তৈরি হয়েছিল, তাও না। সরকারি খাতায় নাম রয়েছে এবং গড়চা রোড ঠিকানা রয়েছে, এই পর্যন্তই। মসজিদের বর্তমান মোয়াজ্জিন, মানে আজান দেন যিনি, সেই সুলেমান আন্সারির বক্তব্য, এই মসজিদ সম্ভবত সত্তর বছরের পুরোনো। যদিও এটা তাঁর অনুমান। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরে কিছু দাঙ্গাবাজ এই মসজিদ ধ্বংস করতে এসেছিল। সুলেমান জানান যে মসজিদটি রক্ষা করেন তাঁর ঠাকুরদা।
একটি মাত্র গম্বুজ এবং পাঁচটি ছোট মিনার রয়েছে গড়চা মসজিদে। দেখে মনে হয় হালে রঙ করা। ভেতরে, মসজিদের সামনের চাতাল করোগেটেড শিট দিয়ে ঢাকা। দেওয়ালের চুনকাম ইত্যাদির অবস্থা দেখে মনে হয় মসজিদটি বেশ পুরোনো। দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রার্থনা কক্ষ। পশ্চিম দিকের দেওয়ালে রয়েছে মেহেরাব – একটি কুলুঙ্গির মত জিনিস, যার কাজ হল কাবার দিক নির্দেশ করা। নামাজ সব সময়ই কাবার দিকে মুখ করেই পড়তে হয় এবং যেহেতু কাবা ভারতের পশ্চিমে, তাই ভারতের অধিকাংশ মসজিদের ঢোকার রাস্তা পুবদিকে এবং ঢুকেই সামনে পড়ে মেহেরাব।
চাতালের বাইরে ছোট্ট ওজুখানা। নামাজ পড়ার আগে হাত, পা এবং মুখ একটি বিশেষ পদ্ধতিতে জল দিয়ে ধুতে হয়। একেই বলে ওজু। প্রত্যেক মসজিদেই ওজু করার ব্যবস্থা থাকে। ধর্মতলার টিপু সুলতান মসজিদের উল্টোদিকে একসময় একটি পুকুর ছিল যেটা ওজুর জন্য ব্যবহার করা হত। তার জায়গায় এখন ট্রাম ও বাসের ডিপো।
প্রার্থনা কক্ষের ভেতরে কার্পেট পেতে নামাজিদের জন্য জায়গা করা রয়েছে। ইমামের জন্য আলাদা জায়গা, মেহেরাবের সামনে। মেহেরাবের পাশে মাইক লাগান রয়েছে আজানের জন্য। বিদ্যুৎ আসার আগে, যখন মসজিদে মাইক ব্যবহার হত না, তখন এই মেহেরাবের তলায় বসেই কথা বলতেন ইমাম। মেহেরাব এমন ভাবে তৈরি করা হত যে তা ইমামের গলার আওয়াজ প্রতিফলিত করে মসজিদের কোণে কোণে পৌঁছে দিত। অবশ্য এইটুকু মসজিদে ইমাম ফিসফিস করে কথা বললেও তাঁর কথা সবার কানেই পৌঁছবে।
বালিগঞ্জ অঞ্চলে মুসলমান বাসিন্দার সংখ্যা খুবই কম। অথচ, শুধু বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডেই ছ’টি মসজিদ রয়েছে। তাহলে কি বালিগঞ্জ অঞ্চল এক সময় একটি মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা ছিল? এলাকার মুসলমান বাসিন্দারা তাহলে গেলেন কোথায়? গবেষণার মাধ্যমে হয়ত একদিন এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। ততদিন, এলাকার ছ’টি মসজিদ হারিয়ে যাওয়া সময়ের স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে।